ভাইয়া, আমি কি ফ্রিল্যান্সিং করবো?
ভাইয়া, আমি কি ফ্রিল্যান্সিং করবো?
এই প্রশ্নটাও আমি প্রায়ই শুনি। দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র অথবা সদ্য পাশ করা (প্রায়) বেকার। আপনি ফ্রিল্যান্সিং করবেন কিনা সেটা আপনার ইচ্ছা কিন্তু আমি আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা শেয়ার করতে চাচ্ছি। এই লেখাটা কম্পিউটার সায়েন্সের বিএসসি ছাত্র/ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে লেখা এই মুহুর্তের মতামত।
আমি নিজে কর্মজীবনের শুরুতে ফ্রিল্যান্সার ছিলাম এবং আমি ফ্রিল্যান্সার হিসাবে গর্বিত। ফ্রিল্যান্সিং আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, অনেক কিছু; এবং ফ্রিল্যান্সিং করে আমি মোটামুটি ভালই উপার্জন করেছিলাম বেশ কম পরিশ্রমে। কিন্তু এতো কিছুর পরও ছাত্র অবস্থায় যদি কেউ আমাকে ফ্রিল্যান্সিং করতে বলতো আমি কি করতাম? আমি মনে হয় করতাম না। আমি কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র ছিলাম। ক্লাশ না করলেও বা জিপিএ সংক্রান্ত কোনো চিন্তাভাবনা না থাকলেও আমার চিন্তাচেতনা তৃতীয় বর্ষ থেকে (যখন থেকে আমি কনটেস্ট করি) কম্পিউটার সায়েন্টিস্টদের মতো হওয়া শুরু করল। হাসার কোনো কারণ নেই, আমি নিজেকে কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট দাবি করছি না, কিন্তু একেকটা অ্যালগরিদম প্রব্লেম সলভার মানে একেকটা খুদে বিজ্ঞানী – এ কথাটা আমি বেশ জোর দিয়ে বলতে পারি। একেকজন উঁচুস্তরের প্রোগ্রামিং কনটেস্ট্যান্ট এমন অনেক অ্যালগরিদম-ডাটা স্ট্রাকচার জানে যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হয়তো কোনো দিন সেগুলোর প্রয়োজনও পড়ে না। যাক গে ধান ভানতেও শিবের গীত গেয়ে ফেলছি, ব্যাক টু ফ্রিল্যান্সিং।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বড় ফ্রিল্যান্সার বলা হয় যার আয় যতো ভাল। আমাদের সমাজব্যবস্থার মতোই নীতি-নৈতিকতার ধার কমই ধারা হয়। আপনার চিন্তা যদি হয় এমন যে, আপনার আসলে টাকা দরকার আপনি ফ্রিল্যান্সিং করতে পারেন, প্রাইভেট পড়াতে পারেন বা আরো অনেক কিছু করতে পারেন। কিন্তু আপনার চিন্তা যদি হয় যে আপনি কিছু শিখতে চান, আপনি প্রোগ্রামিং কনটেস্ট করবেন, ওপেন সোর্স প্রজেক্ট করবেন, ওপেন সোর্সে কন্ট্রিবিউট করবেন।
ছাত্র অবস্থায় ফ্রিল্যান্সিং কেনো করবেন নাঃ আপনি একজন নতুন ফ্রিল্যান্সার। আপনাকে কি মার্কেটে ইন্টারেস্টিং প্রজেক্ট দিবে? আপনি কি একজন সম্পূর্ণ নতুন প্রোফাইলধারীকে একটি কঠিন কাজের জন্য ভাড়া করবেন? করবেন না। আপনার বেলাতেও তাই হবে। আপনাকে শুরু করতে হবে ফালতু সব কাজ দিয়ে (ঘন্টায় ৫ ডলার – ১০ ডলার, আমি শুনেছি কেউ কেউ ১ ডলার / ঘন্টা বা তার নিচেও কাজ করেছে/করে)। কিন্তু আপনার ছাত্র জীবনের এক ঘন্টা আড্ডা আপনি কি পরবর্তীতে ৫ডলার (৪০০- টাকা) দিয়ে পাবেন?
সুতরাং আপনি শুরুতে কাজ পাবেন না। আপনি চান প্রোগ্রামিং সংক্রান্ত কাজ করতে, কিন্তু আপনি দেখবেন হাজার হাজার ডাটা এন্ট্রি ধরণের কাজ, হাজার হাজার ফেসবুকের লাইক/ফলোয়ার চেয়ে কাজ, প্রোগ্রামিং সংক্রান্ত কাজগুলো বেশিরভাগ সময় আপনি কিছুই বুঝবেন না, যেগুলো বুঝবেন ওগুলো ভারী প্রোফাইলধারীরা নিয়ে যাবে। সুতরাং আপনি বাধ্য হয় ডাটা এন্ট্রি বা ওয়ার্ডপ্রেসের ডিজাইন বা HTML ডিজাইন সংক্রান্ত কাজের দিকে ঝুঁকবেন। আপনি যদি ইতিমধ্যে পড়াশোনা শেষ করে থাকেন, তবে এতে আমার কেনো কারোই কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু ছাত্র/ছাত্রী হয়ে থাকলে ছাত্রজীবনের একেক ঘন্টা সময় আপনাকে ২-৩ ডলারের জন্য বিক্রি করতে হবে।
আপনি পাশ করে বের হতে হতে আপনার আয় অনেক থাকবে। আপনি চাকরির জন্য ৫০+ হাজার টাকা বেতনের আশায় থাকবেন। ইন্টারভিউ বোর্ডে আপনাকে জিজ্ঞাস করবে, “থ্রেড কাকে বলে?” বা “রেগুলার এক্সপ্রেশন দিয়ে একটি সংখ্যার বৈধতা নির্ণয় করুন”, আপনার মনে হবে মঙ্গল গ্রহের ভাষা শুনছেন। আপনাকে জিজ্ঞাস করা হল, “বেলম্যান ফোর্ড ও ডায়াক্সট্রার মধ্যে তুলনা করুন” বা “একটা ত্রিভূজের দু’টি বাহু ও সংলগ্ন কোণ দেয়া আছে, তৃতীয় বাহু বের করুন” বা “দু’টি আয়তক্ষেত্রের অবস্থান বিন্দু দেয়া আছে, এ দু’টি পরষ্পরকে স্পর্শ বা কোথাও ছেদ করে কিনা” – আপনি অসহায় বোধ করবেন। একটি রিকার্সিভ ফাংশনের রিটার্ন ভ্যালু জিজ্ঞাস করা হলে আপনি মনে মনে ক্ষিপ্ত হয়ে যাবেন। আপনার মনে হবে এর চেয়ে আপনি নিজে যা করছেন তাই অনেক ভালো।
হ্যাঁ, অবশ্যই আপনার নিজের কাজ ভালো হতে পারে, কিন্তু আপনি কি বুঝতে পেরেছেন যে একজন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে এগুলো পারা আপনার উচিৎ ছিল? আপনি যদি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে থাকেন তাহলে যে কয়েক লাখ টাকা আপনি ব্যয় করেছিলেন তা আসলে জলে গেছে?
সম্ভাব্য করণীয়ঃ ছাত্রজীবন ভালো না লাগলে এবং উদ্যোগী হওয়ার ইচ্ছা থাকলে পড়াশোনা ছেড়ে দিন। বিল গেটস – জাকারবার্গদের আদর্শ অনুসরণ করুন। কথিত আছে স্পেন বিজয়ের সময়ে মুসলিম সেনাপতি যখন উপলদ্ধি করতে পারেন যে সামনে তার বাহিনীর কয়েক গুণ বড় এক বিশাল শত্রু বাহিনী, তখন তিনি সমস্ত জাহাজ পুড়িয়ে দেয়ার আদেশ দেন, যাতে পিছনে ফেরার কোনো উপায় না থাকে। মুসলিমরা সেই যুদ্ধ জয় করেছিল। আমার উপদেশ হচ্ছে যদি সেই মানের উদ্যম ও ভালো কোনো উদ্যোগ প্রস্তুত থাকে তাহলে শিক্ষা অর্জন বাদ দিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিন। আবার খেয়াল রাখবেন মাইক্রোসফট প্রথম অর্ডার পাওয়ার আগে বিল গেটস ড্রপ আউট হয় নি একেবারে অহেতুক ড্রপ আউট হয়ে ইহকাল – পরকাল(বিএসসি ও উদ্যোগ) দু’টাই হারাবেন না।
আরেকটা কাজ করতে পারেন। “পড়ার সময় পড়া আর খেলার সময় খেলা” নীতি মেনে নিয়ে ছাত্রজীবনে ধুন্ধুমার সব প্রজেক্টের সোর্স কোড পড়েন, রোবট বানান, কনটেস্ট করে বেড়ান, গণিত নিয়ে খেলাধুলা করেন। পাশ-টাশ করে ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটে ঢুকে দেখবেন আপনিই মার্কেটের সুপার স্টার। বিড করবেন, বিড জিতবেন, কাজ করবেন, শিখবেন-শেখাবেন। ওহ ভুলে গিয়েছিলাম, “এবং অনেক আয় করবেন”। ফ্রিল্যান্সিং করতে করতেই দেখবেন এক সময় আপনার কাজের চাপে আপনার সহকারী ও সহযোগী প্রয়োজন হবে। হঠাৎ করে দেখবেন আপনার একটি অফিস ও বাহিনী গজিয়ে গেছে।
আমি আজকে কেনো যেনো বাসায় এসে দেখি ফেসবুকে একই প্রশ্ন চার-পাঁচজন করেছে/করে রেখেছে তাই যথাসম্ভব ছোটোখাটো একটা উত্তর দিয়ে রাখলাম। কোনোদিন সময় পেলে কয়েক খন্ডে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করবো। ওহ, শেষ পরামর্শ, পারতপক্ষে ঘন্টাভিত্তিক কাজ করবেন না। ঘন্টাভিত্তিক কাজ করা প্রকৌশলীদের জন্য বেশ অসম্মানজনক।
Posted 14th March 2015 by Muhammed Hedayet
You can visit the blog site
www.fallenprog.blogspot.com